বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হচ্ছে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষা। এই স্তরের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বেসরকারি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত। এসব কলেজে কর্মরত নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। তাঁরা বছরের পর বছর বিনা বেতনে কিংবা সামান্য সম্মানীতে শিক্ষকতা করে চলেছেন- কেবল শিক্ষকতা প্রেম, দায়বদ্ধতা ও ভবিষ্যতের আশায়। অথচ সরকারিভাবে তাঁদের কোনো স্বীকৃতি নেই, নেই এমপিওভুক্তির নিশ্চয়তা বা ভবিষ্যতের নিরাপত্তা।
উচ্চশিক্ষার ছায়ার নিচে অবহেলিত শিক্ষক: দেশে প্রায় ৮০০টির বেশি বেসরকারি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। এসব কোর্স জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হলেও, শিক্ষক নিয়োগ, বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা প্রতিষ্ঠান নিজস্ব উদ্যোগে চালায়। এর মধ্যে বড় একটি অংশের শিক্ষকই নন-এমপিও। অর্থাৎ, তাঁরা সরকারি ভাতা পান না, এমনকি মাসের শেষেও অনেক সময় বেতন পান না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অনার্সের নন-এমপিও শিক্ষক জানান, “প্রতিমাসে তিনি ১২,০০০ হাজার টাকা কলেজ থেকে সম্মানী পাই, সেটাও ২ মাস পরপর দেওয়া হয় । পড়াতে ভালোবাসি বলে টিকে আছি, পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি।”
বেতনহীন শিক্ষা- অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও মূল্যহীন: নন-এমপিও শিক্ষকদের অনেকেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত নিয়মে নিয়োগপ্রাপ্ত, তাঁদের মধ্যে বহুজনের রয়েছে মাস্টার্স বা এমফিল ডিগ্রি, অভিজ্ঞতাও ৫-১০ বছর। কিন্তু এসব কোনো কাজে আসে না, কারণ সরকার তাঁদেরকে বেতন দেয় না, আর কলেজ কর্তৃপক্ষও আর্থিক সীমাবদ্ধতার অজুহাতে সম্মানজনক বেতন দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। অথচ একই নিয়মে অনার্স- মাস্টার্স কোর্সে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক জাতীয়করণ হয়ে এখন সরকারি নিয়মে বেতন ভাতা পাচ্ছে।
চাকরির নিরাপত্তা নেই, ভবিষ্যত নেই: নন-এমপিও শিক্ষকেরা চাকরির কোনো স্থায়িত্ব পান না। যেকোনো মুহূর্তে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে সরিয়ে দিতে পারে। ফলে একদিকে তাঁরা স্থায়ী শিক্ষক নন, অন্যদিকে কোথাও চাকরির অভিজ্ঞতা হিসেবেও তাঁদের সময়কে মূল্যায়ন করা হয় না।
পেনশন নেই, চিকিৎসা নেই, স্বপ্ন নেই: বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরে গেলে কিছুটা হলেও অবসরকালীন সুবিধা পায় কিন্তু নন-এমপিও শিক্ষকদের সে সুবিধা নেই। তাঁদের বার্ধক্য হয় অবহেলায়, তাঁদের অসুস্থতা হয় চুপিসারে, আর মৃত্যুও ঘটে নিঃশব্দে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: বাংলাদেশে অনুমানিক ৫৫০০ হাজারের বেশি নন-এমপিও শিক্ষক অনার্স-মাস্টার্স স্তরে কর্মরত। তাঁদের ৯০ শতাংশের বেতন ১০ হাজার টাকার নিচে, অনেকেই বেতনহীন বা “ক্লাসভিত্তিক সম্মানী” পান।
জাতীয়বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কোর্স পরিচালনায় এই শিক্ষকদের উপর নির্ভরশীল হলেও তাঁদের অধিকার রক্ষায় কার্যকর কোনো নীতিমালা নেই।
সুপারিশসমূহ:
১. নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের জন্য বিশেষ এমপিও স্কিম চালু করা।
২. ন্যূনতম বেতন স্কেল নির্ধারণ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তদারকি নিশ্চিত করা।
৩. চাকরি সুরক্ষা ও অবসরে ভাতা বা পেনশনের জন্য পৃথক তহবিল গঠন।
৪. এই শিক্ষকদের জাতীয় স্বীকৃতি ও পদোন্নতির সুযোগ নিশ্চিত করা।
৫. যে প্রতিষ্ঠানগুলো অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু আছে সেসব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হচ্ছে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স, আর এর ভার বহন করছে একদল অবহেলিত নন-এমপিও শিক্ষক। এঁরা অভাবে থেকেও শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন। অথচ তাঁদের জীবনে কোনো নিরাপত্তা নেই, নেই সামাজিক স্বীকৃতিও। এখনই সময় এই শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়ার। নইলে উচ্চশিক্ষার ভিত দুর্বল হয়ে পড়বে, আর জাতি হারাবে একদল ত্যাগী শিক্ষককে।
ছামিউল ইসলাম রিপন
প্রভাষক – বাংলা
বলদীআটা ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা
ধনবাড়ী, টাঙ্গাইল।
You cannot copy content of this page