দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে ২০০৫ সালে চালু হয় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) এ পরীক্ষার মাধ্যমে নিবন্ধন সনদ প্রদান করে। এই সনদ ছাড়া বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করা যায় না। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত ১৮টি নিবন্ধন পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু উত্তীর্ণের হাড়ভাঙা হার, প্রক্রিয়াজাত জটিলতা এবং শূন্যপদ পূরণে গড়িমসি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার জন্য উদ্বেগজনক হয়ে দাড়িয়েছে।
এনটিআরসিএ’র ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথম থেকে ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় ৯৮ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৭ জন আবেদনকারীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন মাত্র ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৬৬২ জন। এ হার শতকরা ৬.৮৪ ভাগের বেশি নয়। সর্বশেষ কয়েকটি পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণে চিত্রটি আরও ভয়াবহ: ১৪তম নিবন্ধনে প্রায় ৯ লাখ ২৩ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় মাত্র ১৯ হাজার ৮৬৩ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হন। উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন ১৮ হাজার ৩১২ জন। ১৫তম পরীক্ষায় ৮ লাখ ৭৬ হাজার প্রার্থীর মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৩ হাজার ৩৪৫ জন তার মধ্যে চুড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন ১১ হাজার ১৩০ জন। ১৬তম নিবন্ধনে ১১ লাখ ৭৬ হাজার ১৯৬ জনের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন ২২ হাজার ৩৯৮ জন এবং চুড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন ১৮ হাজার ৫৫০ জন। ১৭তম পরীক্ষায় আবেদনকারী ১১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৭৮ জনের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ২৫ হাজার ২৪০ জন এবং মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন ২৩ হাজার ৯৮৫ জন।
সবচেয়ে আলোচিত ১৮তম নিবন্ধনে আবেদন করেন রেকর্ড প্রায় ১৯ লাখ প্রার্থী। লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬৮০ জন। মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হন ৮৩ হাজার ৬৫১ জন, কিন্তু চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন মাত্র ৬০ হাজার ২৫১ জন। অথচ এনটিআরসিএ’র তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্যপদের সংখ্যা ১ লাখ ১ হাজার ১৪২টি। এই বিশাল শূন্যপদের বিপরীতে যোগ্য প্রার্থীদের এভাবে বাদ পড়া শিক্ষাব্যবস্থার জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর নিবন্ধন প্রিলি ও লিখিত উত্তীর্ণরা যখন মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন, তখন ভাইভা বোর্ডের রায় অনেক ক্ষেত্রেই হতাশাজনক।নিয়ম অনুযায়ী, ভাইভায় ২০ নম্বরের মধ্যে ১২ নম্বর বরাদ্দ থাকে একাডেমিক সনদের জন্য। বাকি ৮ নম্বরের মধ্যে মাত্র ৩.২ নম্বর পেলেই একজন প্রার্থী উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্য। এতো নিম্ন পাসমার্ক সত্ত্বেও বিপুল সংখ্যক প্রার্থীকে ফেল করানোয় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উল্লেখ্য, ভাইভার নম্বর জাতীয় মেধাতালিকায় প্রভাব ফেলে না, কেবল উত্তীর্ণ-অনুত্তীর্ণ নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়। তাই এখানে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পেশাদারিত্ব প্রত্যাশিত। কিন্তু ভাইভা প্রার্থীদের অভিযোগ রয়েছে, অনেক ভাইভা বোর্ড প্রয়োজনীয় সময় ব্যয় না করে দ্রুত আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলেন। এতে প্রার্থীদের মধ্যে হতাশা ছাড়াও নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহানি ঘটছে।
দীর্ঘসূত্রিতা ও জটিলতার কারণে শিক্ষক শূন্যপদ পূরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ শিক্ষকরাই শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণ। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করা গেলে এই সংকট দ্রুত কাটিয়ে উঠা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধনপ্রাপ্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে দ্রুত নিয়োগ সম্পন্ন করা জরুরি। পাশাপাশি, শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা দূর করে সময়োপযোগী ও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। এই মেরুদণ্ড শক্তিশালী করতে হলে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও মানবিক মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটানো অপরিহার্য। নিয়োগপ্রার্থীদের মর্যাদা রক্ষা করে এবং যথাসময়ে যোগ্যদের মাধ্যমে শূন্যপদ পূরণের মাধ্যমেই শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত মান ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব। শিক্ষার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করতে শিক্ষক নিয়োগের এই ‘মড়ক’ অবশ্যই থামাতে হবে।
মোঃ ওমর ফারুক,
নেত্রকোনা জেলা।
You cannot copy content of this page