প্রতিবেদক: ছামিউল ইসলাম রিপন:বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকরা জাতি গঠনের কারিগর হিসেবে বিবেচিত হলেও বাস্তবতা বলছে- সব শিক্ষক সমান মর্যাদা ও ন্যায্য বেতন পান না। বিশেষ করে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতন স্কেল ও গ্রেড নিয়ে রয়েছে এক নির্মম বৈষম্য।
বর্তমানে একজন শিক্ষক যখন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ‘সহকারী শিক্ষক’ হিসেবে যোগ দেন, তখনই তিনি ১০ম গ্রেডে (১৬,০০০–৩৮,৬৪০ টাকা) বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত হন, বিএড ডিগ্রি থাক বা না থাক। অন্যদিকে, একজন বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) সহকারী শিক্ষক যদি বিএড বিহীন থাকেন, তাহলে তার প্রথম নিয়োগই হয় ১১তম গ্রেডে (১২,৫০০–৩০,২৩০ টাকা)।
এই গ্রেডেই তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে যদি তিনি বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন, তখনও সেই বিএড স্কেল বাস্তবায়নে তাকে দীর্ঘ প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই তিনি যোগ্যতা প্রমাণ করেও ১০ম গ্রেডে উন্নীত হতে পারেন না বা বিলম্বিত হন।
একই পদবী, কিন্তু ভিন্ন গ্রেড। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের পদবী একই- সহকারী শিক্ষক। কাজের ক্ষেত্রেও রয়েছে সমতা। কিন্তু সরকারি সহকারী শিক্ষক শুরুতেই উচ্চ গ্রেডে থাকেন, আর বেসরকারি শিক্ষকদের একটি গ্রেড নিচ থেকে শুরু করে উচ্চ গ্রেড পেতে লড়াই করতে হয়।
শিক্ষক সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এটি শুধু বেতন বৈষম্য নয়- এটি শিক্ষকতার পেশার মর্যাদাকেও খণ্ডিত করে। একজন সরকারি শিক্ষক প্রথম থেকেই যে সম্মান ও প্রণোদনা পান, বেসরকারি শিক্ষকরা একই কাজ করেও তা পান না।
বাস্তবতা আরও কঠিন। বেসরকারি শিক্ষকরা বিএড কোর্স করতে গিয়ে প্রায় ১ বছর সময়, আর্থিক ব্যয় এবং মানসিক চাপের ভেতর দিয়ে যান। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএড ডিগ্রি নিতে হলে প্রতি বছর ৩০ হাজার টাকার উপরে খরচ হয়। এরপরও সেই ডিগ্রির ভিত্তিতে স্কেল পরিবর্তনের আবেদন করতে হয়, যা মাসের পর মাস-কখনো কখনো বছরের পর বছর ঝুলে থাকে।
প্রশাসনিক নানা শর্ত- যেমন বিএড কলেজের অনুমোদন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি, মাউশির তালিকা, আবেদনপত্রের ফাইল নম্বর ইত্যাদি- এইসব জটিলতা শিক্ষককে আর্থিক ও পেশাগতভাবে দুর্বল করে দেয়।
শিক্ষকরা কী বলছেন? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, “আমি ৭ বছর ধরে এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষক। বিএড করেছি ৫ বছর আগে। এখনও ১০ম গ্রেডে উন্নীত হইনি। নীতিগত জটিলতা দেখিয়ে আবেদন আটকে রাখা হয়। অথচ সরকারি স্কুলে আমার সহপাঠীরা এখন সিনিয়র শিক্ষক।”
শিক্ষকদের অভিযোগ, এর ফলে শিক্ষকতা পেশায় অনীহা বাড়ছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ভালো ডিগ্রি নিয়েও শিক্ষক হতে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
দাবি কী?
১. সহযোগিতাহীন নয়, সমতা ভিত্তিক স্কেল বাস্তবায়ন।
২. সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত সবাইকে সমান গ্রেডে (১০ম গ্রেড) অন্তর্ভুক্তি।
৩. বিএড স্কেল বাস্তবায়ন যেন বাধাহীন, স্বয়ংক্রিয় এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার ভেতর হয়।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষকের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হলে শিক্ষার মানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি-বেসরকারি বিভাজন যদি মেধা ও কাজের মূল্যায়নে প্রতিবন্ধক হয়, তবে তা শুধু শিক্ষক নয়- পুরো জাতিকেই পেছনে ঠেলে দেয়।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকদের মধ্যকার এই গ্রেড বৈষম্য আজ শুধু আর্থিক বা নীতিগত ইস্যু নয়- এটি এক প্রজন্মের আশা, স্বপ্ন ও পেশাগত মর্যাদার প্রশ্ন। সমান কাজের জন্য সমান মজুরি-এটা শুধু নীতিবাক্য নয়, এটি যেন বাস্তবে প্রতিফলিত হয়- এটাই সময়ের দাবি
You cannot copy content of this page