• বৃহস্পতিবার, ০৭ অগাস্ট ২০২৫, ০১:০৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম
চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে নিহত ৩। হাটহাজারীতে স্লুইসগেটের পুনঃনির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়ায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত। থানা থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে ধামইরহাটে ছাত্র-জনতার মানববন্ধন মানিকগঞ্জে বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষ : নিহত ১, আহত ৫ নওগাঁয় অজ্ঞাত মহিলার লাশ উদ্ধার ৮ ধাপে আবেদন ফরম পূরণ ৬ষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তির “সর্বজনীন পেনশন নয়, সরকারি পেনশনই চাই” — আন্দোলনে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। ভালুকায় আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি বাকবিশিস’ ৪৪তম বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার সময়সূচি প্রকাশ

শিরোনাম: হাতুড়ির শব্দে গাঁথা জীবন: এক কামারের সংগ্রামী গল্প

প্রতিনিধির নাম / ১৯১ বার দেখা
আপডেট : বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫

শিরোনাম:

হাতুড়ির শব্দে গাঁথা জীবন: এক কামারের সংগ্রামী গল্প

গল্প

চরাঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেয় এক কামার। তার জন্মভূমি ছিল বন্যার কবলিত চর, অথচ মনের মধ্যে ছিল উন্নতির আগুন। জীবনের সন্ধানে পাড়ি জমান পাহাড়ি অঞ্চলে, যেখানে শুরু হয় তার নতুন অধ্যায়। সেখানে এক টিনের ছাউনি ঘরে গড়ে তোলেন নিজস্ব কর্মশালা। দা, কুড়াল, শাবল বানিয়েই চলত তার জীবিকা।

সেই পাহাড়ি গ্রামেই পরিচয় হয় এক সরলমনা তরুণীর সঙ্গে—নাম কস্তুরী। তিনি ছিলেন আব্দুল কুদ্দুস মিয়ার কন্যা। চেহারায় অপার সৌন্দর্য না থাকলেও তার আচরণ ছিল স্বর্ণের মতো—ধৈর্যশীলা, মমতাময়ী ও সংসারকর্মে দক্ষ।

কামার ছিলেন অশিক্ষিত, তবে তার হৃদয়ে ছিল সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য গভীর চিন্তা। প্রথম সন্তান হিসেবে তাদের ঘরে জন্ম নেয় এক কন্যা—রাহেলা। মেয়ের চোখেমুখে জীবনের স্বপ্ন দেখতে পেতেন তিনি।

তবে কামারের একটি দুর্বল দিকও ছিল—তিনি মাঝে মাঝে জুয়া খেলায় মগ্ন হয়ে পড়তেন। যদিও সংসারিক দুঃখ থাকলেও সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে কখনও আপস করতেন না।

পরবর্তীতে ঘরে আসে আরও তিনটি সন্তান—রাসেল, সাঈদ এবং ছোট্ট মেয়ে আরজিনা। সংসারে দিনদিন অভাব বাড়তে থাকে। কস্তুরী বেগম বাধ্য হন অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতে। চৌধুরী বাড়ির রান্নাঘরে কেটে যেতে থাকে তার দিনের সিংহভাগ।

রাহেলা যখন নবম শ্রেণিতে, তখন কামার হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অপারেশনের খরচ জোগানো পরিবারের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। সেই দুঃসময়ে রাহেলা পড়াশোনা ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান—গার্মেন্টসে চাকরি নেন সংসারের হাল ধরতে।

ঢাকায় কাজ করতে গিয়ে তার পরিচয় হয় এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের সঙ্গে, পরে বিয়ে হয় তাদের। সন্তানের জন্ম হয়, কিন্তু পিতৃগৃহে যোগাযোগ কমে আসে। এদিকে রাসেল ও সাঈদের লেখাপড়া চলে অনটনের মধ্যে দিয়ে।

ছোট মেয়ে আরজিনা ছিল শারীরিকভাবে দুর্বল, হ্যাংলা গড়নের। গ্রামের ছেলে মেয়েরা ব্যঙ্গ করে তাকে “তেলাপোকা” বলে ডাকত, কিন্তু সে এসব কথায় ভেঙে না পড়ে পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল।

একদিন অপারেশনের টেবিলেই থেমে যায় কামারের জীবন। তাঁর হাত আর কখনো উঠেনি—হাতুড়ির শব্দও থেমে যায় চিরতরে। জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি কাটিয়েছেন শয্যাশায়ী অবস্থায়।

তার মৃত্যুর পর সংসারে নতুন ধাক্কা আসে। তবে কস্তুরী বেগম হাল ছাড়েননি। বিধবার জীবন সত্ত্বেও সন্তানদের মানুষ করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যান।

আরজিনার বিয়ে হয় পাশের গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে। সাঈদ পড়াশোনায় মনোযোগী থাকে। রাসেল লেখাপড়া শেষ করে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করে। বাড়তে থাকে পরিবারের আয়, ধীরে ধীরে সংসারে আসে স্বস্তি।

কামার একসময় বলতেন—

> “মানুষ বড় হয় শিক্ষায়, পেশায় নয়। হাতুড়ির শব্দে যেমন লোহা গঠিত হয়, তেমনি অধ্যবসায়ে গড়ে ওঠে জীবনের রূপ।”

এই দর্শনই ছিল তার জীবনের মেরুদণ্ড।

গল্প বিশ্লেষণ ও উপদেশ

এই গল্পটি শুধুমাত্র একটি পরিবারের সংগ্রাম নয়—এটি বাংলাদেশের হাজারো শ্রমজীবী, প্রান্তিক মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি। এক কামার, যিনি অশিক্ষিত হয়েও শিক্ষার মূল্য বুঝতেন, সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য জীবন বাজি রেখে পরিশ্রম করে গেছেন।

গল্পটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—অভাব কখনও মনোবল ভেঙে দিতে পারে না, যদি থাকে দৃঢ় সংকল্প। কস্তুরীর চরিত্র আমাদের শিখিয়ে দেয় কীভাবে একজন মা সংসারের চালিকা শক্তি হতে পারে।

রাহেলা, রাসেল, সাঈদ ও আরজিনার চরিত্র প্রতিফলিত করে—প্রত্যেকে নিজেদের মত করে সংগ্রাম করে গেছেন, কখনও নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে, কখনও অবজ্ঞা সহ্য করে।

 

✓উপসংহার ও শিক্ষণীয় বার্তা

জীবন একটি যুদ্ধক্ষেত্র। দারিদ্র্য, ব্যথা, লাঞ্ছনা আমাদেরকে দুর্বল করে দিতে পারে, কিন্তু সেই মুহূর্তেই সাহসের সবচেয়ে বেশি দরকার। এক কামারের সংগ্রামী জীবন আমাদের শেখায়—

🔹 ভাগ্য বদলায় না নিজে থেকেই, চেষ্টা করতে হয়।

🔹 শিক্ষা জীবনের শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ, তা যে পেশাতেই থাকি না কেন।

🔹 একজন মা-ই পারে পরিবারকে একত্রে ধরে রাখতে।

🔹 সংগ্রামে পিছিয়ে পড়া মানেই হেরে যাওয়া নয়।

📜 “জীবনসংগ্রামে জয়ী হতে হলে—চেষ্টা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।”

[এই গল্পটি আমার গ্রামের]

 

✍️ রচনায়:

মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম 🌼

প্রভাষক, আরবি

বলদিআটা ফাজিল মাদ্রাসা, ধনবাড়ী, টাঙ্গাইল

🗓️ তারিখ: ১৮/০৬/২০২৫গল্প
চরাঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেয় এক কামার। তার জন্মভূমি ছিল বন্যার কবলিত চর, অথচ মনের মধ্যে ছিল উন্নতির আগুন। জীবনের সন্ধানে পাড়ি জমান পাহাড়ি অঞ্চলে, যেখানে শুরু হয় তার নতুন অধ্যায়। সেখানে এক টিনের ছাউনি ঘরে গড়ে তোলেন নিজস্ব কর্মশালা। দা, কুড়াল, শাবল বানিয়েই চলত তার জীবিকা।
সেই পাহাড়ি গ্রামেই পরিচয় হয় এক সরলমনা তরুণীর সঙ্গে—নাম কস্তুরী। তিনি ছিলেন আব্দুল কুদ্দুস মিয়ার কন্যা। চেহারায় অপার সৌন্দর্য না থাকলেও তার আচরণ ছিল স্বর্ণের মতো—ধৈর্যশীলা, মমতাময়ী ও সংসারকর্মে দক্ষ।
কামার ছিলেন অশিক্ষিত, তবে তার হৃদয়ে ছিল সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য গভীর চিন্তা। প্রথম সন্তান হিসেবে তাদের ঘরে জন্ম নেয় এক কন্যা—রাহেলা। মেয়ের চোখেমুখে জীবনের স্বপ্ন দেখতে পেতেন তিনি।
তবে কামারের একটি দুর্বল দিকও ছিল—তিনি মাঝে মাঝে জুয়া খেলায় মগ্ন হয়ে পড়তেন। যদিও সংসারিক দুঃখ থাকলেও সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে কখনও আপস করতেন না।
পরবর্তীতে ঘরে আসে আরও তিনটি সন্তান—রাসেল, সাঈদ এবং ছোট্ট মেয়ে আরজিনা। সংসারে দিনদিন অভাব বাড়তে থাকে। কস্তুরী বেগম বাধ্য হন অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতে। চৌধুরী বাড়ির রান্নাঘরে কেটে যেতে থাকে তার দিনের সিংহভাগ।
রাহেলা যখন নবম শ্রেণিতে, তখন কামার হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অপারেশনের খরচ জোগানো পরিবারের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। সেই দুঃসময়ে রাহেলা পড়াশোনা ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান—গার্মেন্টসে চাকরি নেন সংসারের হাল ধরতে।
ঢাকায় কাজ করতে গিয়ে তার পরিচয় হয় এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের সঙ্গে, পরে বিয়ে হয় তাদের। সন্তানের জন্ম হয়, কিন্তু পিতৃগৃহে যোগাযোগ কমে আসে। এদিকে রাসেল ও সাঈদের লেখাপড়া চলে অনটনের মধ্যে দিয়ে।
ছোট মেয়ে আরজিনা ছিল শারীরিকভাবে দুর্বল, হ্যাংলা গড়নের। গ্রামের ছেলে মেয়েরা ব্যঙ্গ করে তাকে “তেলাপোকা” বলে ডাকত, কিন্তু সে এসব কথায় ভেঙে না পড়ে পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল।
একদিন অপারেশনের টেবিলেই থেমে যায় কামারের জীবন। তাঁর হাত আর কখনো উঠেনি—হাতুড়ির শব্দও থেমে যায় চিরতরে। জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি কাটিয়েছেন শয্যাশায়ী অবস্থায়।
তার মৃত্যুর পর সংসারে নতুন ধাক্কা আসে। তবে কস্তুরী বেগম হাল ছাড়েননি। বিধবার জীবন সত্ত্বেও সন্তানদের মানুষ করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যান।
আরজিনার বিয়ে হয় পাশের গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে। সাঈদ পড়াশোনায় মনোযোগী থাকে। রাসেল লেখাপড়া শেষ করে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করে। বাড়তে থাকে পরিবারের আয়, ধীরে ধীরে সংসারে আসে স্বস্তি।
কামার একসময় বলতেন—
> “মানুষ বড় হয় শিক্ষায়, পেশায় নয়। হাতুড়ির শব্দে যেমন লোহা গঠিত হয়, তেমনি অধ্যবসায়ে গড়ে ওঠে জীবনের রূপ।”
এই দর্শনই ছিল তার জীবনের মেরুদণ্ড।
গল্প বিশ্লেষণ ও উপদেশ
এই গল্পটি শুধুমাত্র একটি পরিবারের সংগ্রাম নয়—এটি বাংলাদেশের হাজারো শ্রমজীবী, প্রান্তিক মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি। এক কামার, যিনি অশিক্ষিত হয়েও শিক্ষার মূল্য বুঝতেন, সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য জীবন বাজি রেখে পরিশ্রম করে গেছেন।
গল্পটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—অভাব কখনও মনোবল ভেঙে দিতে পারে না, যদি থাকে দৃঢ় সংকল্প। কস্তুরীর চরিত্র আমাদের শিখিয়ে দেয় কীভাবে একজন মা সংসারের চালিকা শক্তি হতে পারে।
রাহেলা, রাসেল, সাঈদ ও আরজিনার চরিত্র প্রতিফলিত করে—প্রত্যেকে নিজেদের মত করে সংগ্রাম করে গেছেন, কখনও নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে, কখনও অবজ্ঞা সহ্য করে।

✓উপসংহার ও শিক্ষণীয় বার্তা
জীবন একটি যুদ্ধক্ষেত্র। দারিদ্র্য, ব্যথা, লাঞ্ছনা আমাদেরকে দুর্বল করে দিতে পারে, কিন্তু সেই মুহূর্তেই সাহসের সবচেয়ে বেশি দরকার। এক কামারের সংগ্রামী জীবন আমাদের শেখায়—
🔹 ভাগ্য বদলায় না নিজে থেকেই, চেষ্টা করতে হয়।
🔹 শিক্ষা জীবনের শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ, তা যে পেশাতেই থাকি না কেন।
🔹 একজন মা-ই পারে পরিবারকে একত্রে ধরে রাখতে।
🔹 সংগ্রামে পিছিয়ে পড়া মানেই হেরে যাওয়া নয়।
📜 “জীবনসংগ্রামে জয়ী হতে হলে—চেষ্টা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।”
[এই গল্পটি আমার গ্রামের]

✍️ রচনায়:
মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম 🌼
প্রভাষক, আরবি
বলদিআটা ফাজিল মাদ্রাসা, ধনবাড়ী, টাঙ্গাইল
🗓️ তারিখ: ১৮/০৬/২০২৫


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ

You cannot copy content of this page