মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে এই পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন। বিবেক, বুদ্ধি, আত্মসংযম ও মনুষ্যত্ববোধের কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা। মানুষ হলে তার মাঝে মানবিকতা থাকবে, সে অন্যের অনুভূতি বুঝবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজেকে আত্মনিয়োগ করবে। এরূপ মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষা লাভ একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষের ইতিবাচক আচরণিক পরিবর্তন ঘটে।
একজন শিশু জন্মের পর থেকেই শিক্ষা লাভ শুরু করে। প্রথমত পারিবারিক শিক্ষা, দ্বিতীয়ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। নেপোলিয়ান বলেছেন, মায়ের শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যতের বুনিয়াদ। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, একজন শিশুর পারিবারিক শিক্ষাই হচ্ছে তার জীবনের মূলভিত্তি। পরিবার থেকেই শিশুর মাঝে সততা, নৈতিকতাবোধ, মনুষ্যত্ববোধ ইত্যাদি গুণাবলি তৈরী হতে থাকে। শিশুর মানবিকতা বিকাশে পারিবারিক শিক্ষা অপরিহার্য। একজন শিশুর জীবনে সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো তার পরিবার। যেখানে বাবা-মা, পরিবার-পরিজন প্রত্যেক সদস্যই শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারে। এজন্য পরিবারের সদস্যদেরও নৈতিক গুণাবলি সম্পন্ন হওয়া খুবই জরুরি। পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে সার্টিফিকেট অর্জনপূর্বক একজন শিশু শিক্ষিত মানুষে পরিণত হয়ে ওঠে।
শিক্ষিত হওয়ার চেয়েও ভালো মানুষ হওয়া যে খুব বেশি প্রয়োজন এতে সন্দেহ নেই। কেননা, ‘দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য। শিক্ষিত মানুষ হবার পাশাপাশি ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত শিক্ষার প্রতি মনোযোগ দিলেই হবে না, সাথে সাথে ধর্ম, নৈতিকতা ও সামাজিকতাবোধ চর্চার প্রসার ঘটাতে হবে। এর ফলে প্রত্যেক শিক্ষার্থী সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে। শিক্ষার্থী যদি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়, তাহলে সে কখনো অন্যায় ও অসৎ পথে পা বাড়াবে না, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে কখনো দ্বিধাবোধ করবে না। নিজ সত্তাকে জানার চেষ্টা করবে এবং মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করবে। চার্চিল বলেছেন, একজন মানুষের কাছে তার একমাত্র পথপ্রদর্শক হচ্ছে তার বিবেক, তার মরণোত্তর খ্যাতির একমাত্র ধর্ম হচ্ছে তার সততা এবং তার আচরণের আন্তরিকতা। বিবেকই মানুষকে আত্মোপলব্ধি করতে শেখায়; দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
নটরডেম কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় একটা ঘটনা আজো আমার হৃদয় মানসপটে জাগ্রত। অধ্যাপক সুশান্ত স্যার আমাদের ফিজিক্স পড়াতেন। প্রতি সপ্তাহেই কুইজ পরীক্ষা হতো। বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে ফিজিক্সের কুইজ পরীক্ষার প্রশ্ন একটু কঠিনই হতো। সুশান্ত স্যার কুইজ পরীক্ষা এবং টার্ম পরীক্ষাগুলোতে অনেক ছাত্রকেই ইচ্ছা করে ১০ নম্বর বেশি দিতেন। এটা আমরা অনেকেই প্রথম প্রথম বুঝতাম না।
কোন এক কুইজ পরীক্ষায় আমি এবং কয়েক বন্ধু ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। আমার খাতার উপরে নাম্বার দেয়া ৪২ ,অথচ খাতার ভিতরের নাম্বার যোগ করে দেখলাম, পেয়েছি মূলত ৩২। মানে স্যার খাতার উপরে ১০ বেশী লিখেছেন। ১০ নম্বর বেশি পেয়েছি!! বাহ! বেশ খুশীই হলাম। পাশের আরেক বন্ধুর খাতা চেক করে দেখলাম, ওর খাতায়ও একই কাহিনী। ওর খাতার উপরেও ১০ নাম্বার বেশী দেয়া। ব্যাপারটা নিয়ে যথেষ্ট কৌতুহল হচ্ছিলো যে, স্যার একইরকম ভুল কিভাবে করলেন?
কিছুক্ষণ পরে স্যার ক্লাসে প্রশ্ন করলেন- ‘কারো কোনো সমস্যা আছে?’: আমি এবং পাশের বন্ধু দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি বিড়বিড়িয়ে বললাম- ‘স্যার! আপনি ভুল করে ১০ নম্বর বেশি দিয়েছেন আমাকে এবং আমার পাশের বন্ধুর ক্ষেত্রেও একই ভুল করেছেন। আমি মূলত ফেল করেছি কুইজে, ওই ১০ বেশী পেয়েই পাশ হয়েছে।’ সাথে সাথে আরো ৬/৭ জন ছাত্র দাঁড়িয়েও একই কথা বললো।
স্যার আমাদের কথা শুনে মুচকি হাসলেন। স্যার বললেন, ‘তোমাদের ওই ১০ নম্বর আমি পুরষ্কার হিসেবে দিলাম।’ বাকীদের উদ্দেশ্যে বললেন- ‘আমি আরো কিছু ছাত্রকে ১০;নম্বর করে বেশি দিয়েছি, প্রত্যেকের নামই আমার কাছে লেখা আছে, অন্য সবাই কিন্তু কিছু বললে না। তোমরাও হয়তো খেয়াল করেছিলে, কিন্তু প্রকাশ করোনি।’
বাবারা, আজকের ক্লাসের শিক্ষা হলো- “ছোটো খাটো লোভ সামলাতে হবে, নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। তোমাদের মধ্যে যারা লোভ কে জয় করতে পারব, তারা কখনো জীবনে ঠকবা না। হাজার মানুষ ঠকাতে চাইলেও ঠকাতে পারবে না। তারা টেনে ধরবে তোমাদের পেছন থেকে, তাও তোমরা এগিয়ে যাবা অপ্রতিরোধ্য গতিতে। যারা পার্থিব লোভে নিমগ্ন থাকবা, তারা শেষ পর্যায়ে নিজেকে আবিষ্কার করবা ঠকে যাওয়াদের কাতারে। আজ যারা ১০ নম্বরের লোভ সামলাতে পারলানা, তারা হয়তো একসময় কোটি টাকার লোভে বিবেকবোধ বিসর্জন দিয়ে দিবা। আমি চাইনা আমার ছাত্ররা অসৎ হোক। সৎ হবা, জীবনে কামিয়াব হবা।“
হ্যাঁ, শিক্ষার্থীদের মাঝে এরকম দৃষ্টিভংগী গড়ে তুলতে পারলেই তারা সমাজ সংসারে ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে স্থান করে নিতে পারবে। ভাল মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-বেঠিক এই চেতনা যখন শিক্ষিত মানুষের থাকবেনা, তখন দেশে সুনাগরিক ও সভ্য সমাজ কখনোই গড়ে উঠবে না। আমরা চাই সুশিক্ষিত ভালো মানুষ। তাই শুধু ভালো ফলাফল করার দিকে নজর না দিয়ে, শিক্ষার্থীদের উত্তম চরিত্র ও মনুষ্যত্বের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে।
একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি তাকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে মূখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। শিক্ষাদান এবং শিক্ষা গ্রহণ, এরূপ দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমেই গড়ে ওঠে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুন্দর সম্পর্ক। দাতা গ্রহীতার সম্পর্কের চেয়ে অনেক পবিত্র এ সম্পর্ক। শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থী কেবলই জ্ঞান লাভ করবে না, তার উপদেশ ও পরামর্শ থেকে সে পেতে পারে জীবন ও চরিত্র গঠনের মূল্যবান নির্দেশনা। শিক্ষকের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্বারা সমৃদ্ধ হতে চাইলে তার প্রতি শিক্ষার্থীকে হতে হবে শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত, থাকতে হবে তার ওপর গভীর আস্থা। মনে রাখতে হবে, মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়া জরুরী নয়, তবে অনুগত শিক্ষার্থী হওয়া ভীষণ জরুরী।
যদি আমরা শিক্ষক পরিবার নৈতিকতা, মূল্যবোধ ধারণ ও পালন করি এবং প্রতি ক্লাসে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ে কিছু সময় আলোচনা করি, অভিভাবকরা যদি তাদের নিজ সন্তানদের মানবিক গুনাবলি বিকাশে যত্নশীল হয়ে ওঠেন, কেবল তখনই শিক্ষিত জাতির সাথে সাথে ভালো মানুষের সংখ্যাও বাড়বে। শুধু ভালো ফলাফল করার দিকে নজর না দিয়ে শিক্ষার্থীদের উত্তম চরিত্র ও মনুষ্যত্বের দিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সমাজ সংস্কার করে ভালো মানুষ হওয়ার রাস্তাটাও তৈরী করে দিতে হবে।
আমাদের প্রয়োজন সুশিক্ষায় শিক্ষিত মানবিক প্রজন্ম। মেধাবী ও দক্ষ প্রজন্মের চেয়ে মানবিক ও দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ে তোলা বেশি জরুরি। তারা অন্ধকার ও দুর্দশাগ্রস্ত জাতিকে অনির্বাণ আলোর ঠিকানায় পৌঁছে দেবে। যেখানে থাকবে মানবিকতার ছোঁয়া, সত্য ও সুন্দরের চর্চা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও মহৎ প্রাণের আদর্শ। প্রকৃত মানুষ তথা ভালো মানুষ তৈরী হলেই সুশোভিত সমাজ ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
মো আরিফুজ্জামান,
এক্স নটরডেমিয়ান,
বিএসসি, বিএড, এলএলবি
সিনিয়র শিক্ষক (গণিত)
ইন্দুরকানী মেহেউদ্দিন মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়
You cannot copy content of this page