বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একটি জনগণনির্ভর কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসাগুলোতে। কিন্তু যে শিক্ষকগণ এই বিশাল শিক্ষার্থীবহরকে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিচ্ছেন, তাদের জীবন এখনও ঘোর অনিশ্চয়তা, বৈষম্য ও অবহেলার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো—এমপিওভুক্ত শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা এবং শিক্ষকদের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা।
শিক্ষকদের জীবনযাপন: বঞ্চনার প্রতিচ্ছবি
বর্তমানে একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক বাসাভাড়া বাবদ পান মাত্র ১,০০০ টাকা, যা দিয়ে দেশের কোনো প্রান্তেই সম্মানজনক আবাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। রাজধানী বা বিভাগীয় শহরের কথা তো বাদই দিন, জেলা শহরেও এই টাকায় কোনও সাধারণ ঘর পাওয়া যায় না। অথচ একজন সরকারি কর্মচারী শুধু বাসাভাড়া নয়, তার আবাসনের জন্য সরকারি কোয়ার্টার, টিএ/ডিএ, যাতায়াত সুবিধাসহ বহু সুযোগ-সুবিধা পান। একইভাবে, চিকিৎসা ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা। যেখানে বর্তমান চিকিৎসাব্যয় আকাশচুম্বী, সেখানে এই টাকায় ওষুধের একটি স্ট্রিপও কেনা যায় না। অথচ সরকারি কর্মচারীরা পান ১,৫০০ টাকা কিংবা তার চেয়েও বেশি চিকিৎসা ভাতা। বিষয়টি শুধু বৈষম্য নয়—এটি একটি শ্রেণিভেদমূলক নীতির বহিঃপ্রকাশ।
উৎসব ভাতা আন্দোলনের ফসল
এক সময় এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা উৎসবকালীন সময়ে কোনো ভাতা পেতেন না। এরপর ২০০৪ সালে বিএনপি সরকার ২৫% উৎসব ভাতা চালু করে। এটি শিক্ষক সমাজের জন্য এক ধরনের স্বস্তির নিঃশ্বাস ছিল, কিন্তু এরপর দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে এই হার অপরিবর্তিত ছিল। শিক্ষকদের প্রাপ্য ছিল পূর্ণ উৎসব ভাতা, কিন্তু বছরের পর বছর তাঁরা আন্দোলন করেও এই ন্যায্যতা পাননি।
অবশেষে, ২০২৫ সালে দীর্ঘ ২২ দিনের টানা আন্দোলন, অনশন ও রাজপথে অবস্থানের মধ্য দিয়ে কিছুটা সাড়া মেলে। অলস গতিতে হলেও উৎসব ভাতা ২৫% থেকে বাড়িয়ে ৫০% করা হয়। এটি আন্দোলনের একটি অর্জন নিঃসন্দেহে, কিন্তু এটি ছিল দাবির মাত্র একটি অংশ। বাড়িভাড়া ভাতা বৃদ্ধি, চিকিৎসা ভাতা সমতা, বিনোদন ও শ্রান্তিভাতা, বদলির সুযোগ ও অবসরকালীন পেনশন সুবিধা—এই মৌলিক দাবিগুলো এখনও অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়ে গেছে। যদিও শিক্ষক সমাজ আশাবাদী, অবশিষ্ট দাবিগুলোর বাস্তবায়নও খুব শিগগিরই হবে।
জাতীয়করণ না হলে শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়
একজন শিক্ষক যদি সারাজীবন দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা ও অসম্মানের মধ্যে কাটান, তাহলে তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের মাঝে আলো ছড়াবেন? উন্নত বিশ্বে শিক্ষকদের মর্যাদা সর্বোচ্চ স্তরে রাখা হয়—তাদের জন্য থাকে সুদৃঢ় নিরাপত্তা, সম্মান ও স্থায়িত্ব। বাংলাদেশে সেই বিপরীত চিত্র। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা আজও বদলির সুযোগ থেকে বঞ্চিত। কর্মস্থল পরিবর্তনের কোনো আইনি পথ তাদের জন্য খোলা নেই। অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধাও অনেকটাই অনিশ্চিত ও জটিল।
অন্যদিকে, সরকারের নানা শিক্ষা প্রকল্পের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে লোপাট হয়ে যায়। তদ্ব্যতীত, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত বেতন-সংক্রান্ত অর্থ অনেক সময় যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠানে ব্যয় না হয়ে নানা ভাবে অপচয় হয়। এই অর্থগুলো যদি সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে এবং জাতীয় বাজেটের আওতায় আসে, তাহলে তা আরো স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও টেকসই হবে।
জাতীয়করণ মানে মর্যাদা ও নিরাপত্তা
শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করার অর্থ শুধুই বেতন বৃদ্ধি নয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন নিশ্চিত করা। জাতীয়করণ হলে শিক্ষকগণ পাবেন সরকারি সুযোগ-সুবিধা, বদলির অধিকার, পেনশন ব্যবস্থা এবং নিয়মতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়নের সুবিধা। এতে শিক্ষক পেশাটি একটি আদর্শ, মর্যাদাপূর্ণ ও আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে গড়ে উঠবে—যা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির একমাত্র পথ।
এখনই সময়, আর নয় অবহেলা
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা জাতি গঠনের কারিগর। তাঁদের সম্মানিত না করে, তাঁদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না করে, শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। জাতীয়করণ কোনো দয়া নয়, এটি ন্যায্যতার প্রশ্ন। এটি অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই।
তাই সময় এসেছে—সকল এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করে, শিক্ষকদের জন্য সমানাধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার। একটি উন্নত, মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এটি এখন আর বিলম্ব করার বিষয় নয়—এটি তাৎক্ষণিক বাস্তবায়নের দাবি।
মোহাম্মদ আল আমিন
বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার, কম্পিউটার সায়ন্স
প্রভাষক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
You cannot copy content of this page