গত ১৫ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় ২০১০ সালের পর থেকে এ বছরের ফলাফলে একেবারেই বিপরীত দৃশ্য ফুটে উঠেছে। চলতি বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীই ফেল করেছে।
কেউ কেউ এই ফলাফলকে বিপর্যয় হিসেবে উল্লেখ করছেন, আবার অনেকের মতে এবার যথার্থ মূল্যায়ন হয়েছে বলেই প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) প্রকাশিত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, চলিত বছর ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পাসের হার ৬৮ দশমকি ৪৫ শতাংশ।
বিগত এক যুগ ধরে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য সহজ প্রশ্নে পরীক্ষা, নম্বর বাড়িয়ে দেয়া, খাতা মূল্যায়নে শিথিলতাসহ নানা পদ্ধতিতে আকাশচুম্বী পাসের হার দেখানো হয়েছিল।
এভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে পরীক্ষায় ফলাফলে কথিত বাম্পার ফলন দেখানোর প্রবণতায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শিক্ষার্থী তথা সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা।
বিশেষজ্ঞদের অনেকে আবার বলছেন, এই ফলাফলের পেছনে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, খাতা মূল্যায়নে স্বল্প সময়, শিক্ষার্থীদের লার্নিং গ্যাপ, বারবার কারিকুলামে পরিবর্তন, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, শিক্ষক সংকটসহ নানা কারণ রয়েছে।
শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, গ্রাম বা শহরের সুযোগসুবিধা বা বৈষম্য বিবেচনায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। একই প্রশ্নে সবার পরীক্ষা নিই আমরা, কিন্তু সবার সুযোগ তো এক না। এ কারণেই এবারও অতীতের মতো গ্রামের শিক্ষার্থীদের ফলাফল তুলনামূলক খারাপ হয়েছে।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সব বোর্ডেই গণিতে খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা। যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক পাশের হারে। দেশের ১১ শিক্ষা বোর্ডে প্রায় ২৩ শতাংশ ছাত্রছাত্রী গণিতে ফেল করেছেন। ইংরেজিতেও ভালো করতে ব্যর্থ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী।
ফল খারাপের কারণ হিসেবে নানা যুক্তি তুলে ধরছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। অভিভাবকদের কেউ কেউ বলছেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আন্দোলনসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীদের বড় একটি সময় অনিশ্চতায় কেটেছে, যা ফল বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ।
এছাড়াও বিগত বছরগুলোতে যেভাবে ঢালাওভাবে পাস করিয়ে পাশের হার বেশী দেখানো হতো, এবছর সেই প্রথা থেকে ফিরে এসেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণিতের একজন পরীক্ষক জানান, এ বছর পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে কোন রকম ছাড় দেয়া হয়নি। শিক্ষাবোর্ড থেকে এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পাসের হার কমেছে।
গণিত ও ইংরেজিতে অধিক শিক্ষার্থী ফেল করার পিছনে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক সংকটের ব্যাপারও উঠে এসেছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে যারা পাঠদান করেন, তাদের অধিকাংশ শিক্ষকের স্নাতক পর্যায়ে ঐ বিষয়ই ছিলো না। এমনকি বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন, পরীক্ষক ও নীরিক্ষকের দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত শিক্ষকগণ ও অনেক ক্ষেত্রে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক থাকেন না বলে জানিয়েছেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক। এভাবেই চলছে শিক্ষা বোর্ড গুলোর কার্যক্রম। এ কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই গণিত ও ইংরেজি প্রশ্নপত্রের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
২০১০ সাল থেকে দেশে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ওই বছর মাধ্যমিকে গড় পাশের হার ছিল ৮০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ৮০ শতাংশের ওপর পাশের হার দেখা যায়।
২০২১ এর করোনা অতিমারির সময় পাশের হার দাড়ায় ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। যদিও সেবার মাধ্যমিক অটোপাশ দেওয়া হয়েছিল। এরপর ২০২৩ সালে পাশের হার কিছুটা কমে ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ হলেও গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে পাশের হার হয় ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ।
মফস্বলের বিদ্যালয় গুলোর ফলাফল খারাপ হবার পিছনে শিক্ষক ও অভিভাবকদের ভিন্ন কথাও বলতে শোনা যাচ্ছে। অভিভাবকদের মতে, করোনা চলাকালীন শিখনের যে ঘাটতি হয়েছিল, সেটাই ফলাফলে উঠে এসেছে। মফস্বলের শিক্ষকেরা এর পিছনে ম্যানেজিং কমিটির খবরদারি কেও দায়ী করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গণিত শিক্ষক বলেন, মফস্বলের বিদ্যালয় গুলোতে টেস্ট পরীক্ষা হয় লোক দেখানো। ম্যানেজিং কমিটি এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ/অনুত্তীর্ণ সকলকেই ফরম ফিলাপ করাতে হয়। ফলে, একদিকে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় অমনোযোগীতা এবং অপরদিকে অভিভাবকদের উদাসীনতা তৈরী হয়। পাসের হার কম হওয়ার এটাও অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন অনেক শিক্ষক। এক্ষেত্রে, বোর্ড থেকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হলে মফস্বলের পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটতে পারে বলে মনে করেন শিক্ষক – অভিভাবক গণ।
শিক্ষাবিদদের অনেকে মনে করেন, মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ওভার মার্কিং বা আন্ডার মার্কিং ইস্যুতে ধীরে ধীরে একটি সঠিক জায়গায় আসার চেষ্টা করবে সরকার। এ বছর পাশের হার যতটা হয়েছে সামনের বছর এই হার এর থেকেও কম হতে পারে।
তবে, সার্বিকভাবে শিক্ষার মানোন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা যেমন দরকার, ঠিক তেমনি শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করতে শিক্ষায় বরাদ্দও বাড়ানো দরকার।
এম. আরিফুজ্জামান, সিনিয়র শিক্ষক (গণিত),
ইন্দুরকানী মেহেউদ্দিন মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পিরোজপুর ।
You cannot copy content of this page