নিজস্ব প্রতিবেদক:”সব কটা জানালা খুলে দাও না…”
এই একটি লাইনেই আটকে আছে একটি সময়, একটি দেশ, একটি মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
আর এই চিরন্তন পঙ্ক্তির স্রষ্টা — নজরুল ইসলাম বাবু। যিনি গানের প্রতিটি শব্দে নিপুণ হাতে এঁকেছিলেন বাংলাদেশকে, মানুষের হৃদয়ের ক্ষরণকে।
জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার ছোট্ট গ্রাম চরনগর। সেখানেই ১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই জন্ম নিয়েছিলেন এক প্রতিভা, যাঁর লেখা গান আজও বাঙালির আবেগের ভাষা। পিতার নাম বজলুল কাদের — এক সংগীতপ্রেমী মানুষ। মাতা রেজিয়া বেগম — স্নেহময়ী, সহানুভূতিশীল। পৈত্রিক ভিটা হেমাড়াবাড়ি গ্রাম।
তাঁর শৈশব কেটেছে নদীর পাড়, মাঠের সবুজ আর মাটির ঘ্রাণে। গানের প্রেম জন্ম সেখানেই।
পড়েছেন জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএসসি পাস করেন। কিন্তু শুধু পাঠ্যপুস্তকের ছাত্র ছিলেন না, ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন-এর সাহসী মুখ।
রাজনীতি, সংস্কৃতি আর সমাজচেতনার সেই শুরুই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ে— মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭১। দেশ টালমাটাল। অস্ত্র নয়, কখনো গান, কখনো শ্লোগান, আবার কখনো লড়াইয়ের মাঠে — নজরুল ইসলাম বাবু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি অংশ।
এই দেশ, এই স্বাধীনতা — তাঁর জন্য শুধু রাজনৈতিক ইস্যু নয়, ছিল হৃদয়ের গভীর দায়।
১৯৭৩ সালে তালিকাভুক্ত গীতিকার হিসেবে বাংলাদেশ বেতার ও টিভিতে যুক্ত হন। তারপর, যাত্রা শুরু এক নতুন সংগ্রামের — শব্দ দিয়ে অনুভব গড়ার।
তিনি লিখেছেন প্রায় ১১৩টি গান, যার অনেকগুলো আজ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আত্মার অংশ হয়ে উঠেছে।
কালজয়ী গানগুলো:
* “সব কটা জানালা খুলে দাও না”
* “একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার”
* “দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল”
* “আমায় গেঁথে দাও না মাগো”
* “এই অন্তরে তুমি ছাড়া নেই কারো”
এসব গানে ছিল প্রেম, প্রতিবাদ, পীড়া আর আশার স্পর্শ।
যেনো প্রতিটি শব্দে ফুটে উঠেছে একজন মানুষ, একজন দেশ, একটি সময়।
বাংলা চলচ্চিত্রেও ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি।
‘দুই পয়সার আলতা’, ‘মহানায়ক’, ‘প্রতিরোধ’, ‘উসিলা’, ‘প্রেমের প্রতিদান’— সিনেমাগুলোতেও জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর গানের অনুপম কথামালা।
তাঁর গীতরচনার স্বীকৃতি স্বরূপ, মৃত্যুর পর ১৯৯১ সালে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, সিনেমা: “পদ্মা মেঘনা যমুনা”।
তাঁর লেখা গান গেয়েছেন উপমহাদেশের কণ্ঠশিল্পীদের সেরা নামগুলো:
সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সুবীর নন্দী, এন্ড্রু কিশোর, কুমার শানু, আশা ভোঁসলে, হৈমন্তী শুক্লা।
তাঁর শব্দে যেমন ছিল ঘ্রাণ, তেমনি শিল্পীদের কণ্ঠে ছিল প্রাণ।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন স্ত্রী শাহীন আক্তার-এর ভালোবাসার সঙ্গী এবং দুই কন্যা নাজিয়া ও নাফিয়া-র গর্বিত পিতা।
তিনি শুধু গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন সংগঠকও।
বাংলাদেশ গীতিকবি সংসদ-এর সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন ১৯৭৮–৭৯ সালে।
১৯৯০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর, মাত্র ৪১ বছর বয়সে চিরপ্রস্থান করেন নজরুল ইসলাম বাবু।
কিন্তু তাঁর গান আজও জীবনের নানা বাঁকে, জাতির স্মৃতিতে, ইতিহাসের করিডোরে ধ্বনিত হয়।
প্রতিটি প্রজন্ম যখন গান গায়-
“একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার…”
তখন সেই অদৃশ্য লাইনেই বাঁধা থাকে নজরুল ইসলাম বাবুর চেতনা।
নজরুল ইসলাম বাবু আমাদের শিখিয়ে গেছেন, গান শুধু বিনোদন নয়— তা হতে পারে অস্ত্র, হতে পারে আদর্শ, হতে পারে জাতির আত্মার আয়না।
তাঁর শব্দে আজও বাংলাদেশ গান গায়, গেয়ে যাবে — যতদিন এই ভাষা থাকবে, এই দেশ থাকবে।
তাঁর প্রতি রইল ভিতর দিয়ে এক বাংলাদেশ।
You cannot copy content of this page