একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও আজ আমরা কেবল একটি পরিচয় বহন করি—গড়পড়তা সাধারণ মানুষ। যাদের জীবন একবারে হিসেবের বাইরে। আমরা জন্মাই, ভোট দেই, কর দেই, পরিচয়পত্র করি, আবার একদিন হারিয়ে যাই—কারও চোখে জল পড়ে না, প্রতিবাদ হয় না, বিচার হয় না।
গতকাল যারা বিমান দুর্ঘটনায় মাইলস্টোন কলেজের শিশু শিক্ষার্থীরা অকালে প্রাণ হারাল—তাদের অপরাধ কী ছিল? তারা তো শুধুই ভবিষ্যতের স্বপ্ন ছিল, যাদের বইয়ে লেখা ছিল “স্বাধীনতা”, “আইন”, “সুরক্ষা”। কিন্তু বাস্তবতা বলল, এই রাষ্ট্র শুধু পাঠ্যবইয়ে ভালো—জীবনে নয়।
সারা দেশে কত মানুষ খুন হচ্ছে, কত নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে—কেউ কি জানে কতজনের বিচার হয়েছে? হয়তো কেউ কেউ জেলে যায়, মিডিয়ায় কিছুদিন হেডলাইন হয়, তারপর ঠিকই জামিনে বেরিয়ে আসে। ক্ষমতার ছায়ায় অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে ঘোরে, আর ভুক্তভোগীরা বাঁচার মতোও বাঁচে না।
আমরা এমন এক রাষ্ট্রে বাস করি, যেখানে লাশের চেয়ে পরিচয়পত্র বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে মানুষের আর্তনাদ সরকার শুনে না, নেতার হাঁচি নড়ায় গোটা প্রশাসন।
এখানে যারা মরছে, তারা সাধারণ মানুষ—তারা অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে এই ব্যবস্থার কাছে।
প্রতিবার একটা শোরগোল হয়, কিছু প্রতিবাদ হয়, কিছু ক্যামেরা ফ্ল্যাশ হয়—তারপর সব চুপ। যেন কিছুই ঘটেনি। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি আজ আমাদের গণতন্ত্রকে গিলে খাচ্ছে, আমাদের নিরাপত্তাবোধকে মেরে ফেলছে।
যেখানে সেখানে মানুষ মারা যায়। ট্রাকে চাপা পড়ে, ক্রেনে মাথা ফাটে, গ্যাস লিক হয়ে পুড়ে যায়। কিন্তু কেউ জবাবদিহি করে না। কারণ আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রের হৃদয়ে কম্পন আসে না।
এদিকে যাদের হাতে ক্ষমতা, তারা হাজার কোটি টাকা লোপাট করে, বিদেশে বাড়ি বানায়, ব্যাংক লুট করে, আবার গর্ব করে টক শোতে বলেন—“দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে!” কী নির্মম রসিকতা!
নিরাপত্তা চেয়ে আমরা এখন ভীত। বাজারে গেলে ভয়, বাসে উঠলে ভয়, সন্তান স্কুলে পাঠালে ভয়—ফিরবে তো? না কী আরেকটি হেডলাইন হবে সে?
এখন চাঁদা না দিলে প্রাণ যায়। প্রতিবাদ করলে গুম হয়। সাংবাদিক হলে লাশ হয়। শিক্ষক হলে বঞ্চিত হয়। ছাত্র হলে গুলি খায়। আর নেতা হলে পায় লাইসেন্স—চুরি, খুন, ক্ষমতার।
তাহলে আমাদের ভূমিকা কী? শুধু ট্যাক্স দিয়ে রাষ্ট্রের শাসকদের বিলাসিতা নিশ্চিত করা? আমাদের জীবন এতোই সস্তা?
না, আর না।
এই মৃত্যু, এই ধর্ষণ, এই গুম, এই বিচারহীনতা—এগুলো আমরা আর মেনে নেব না। আমাদের চোখে পানি আছে, কিন্তু সে পানি জলের মতো নয়—সে আগুন। সে আগুন একদিন জ্বলে উঠবেই। তখন আর ক্ষমতাবানদের প্রটোকল কাজ করবে না। তখন সত্যি হবে—“জনতার রোষের আগুন নিভে না সহজে।”
মো: তানজিম হোসাইন
কলামিস্ট, শিক্ষক এবং সাংবাদিক
You cannot copy content of this page