এম. আরিফুজ্জামান, নিউজ ডেস্ক:সময়ের পরিক্রমায় আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীর সংখ্যাও। কিন্তু এই সংখ্যাবৃদ্ধি মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি, যার প্রমাণ উচ্চশিক্ষিত বেকারের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা এবং বৈশ্বিক মানদণ্ডে দেশের পিছিয়ে পড়া অবস্থান। আমাদের শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে, বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে। এমনকি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষা ও গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি।
বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত মান নিয়ে ক্রমেই উদ্বেগ বাড়ছে। সাম্প্রতিক গবেষণা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এইচএসসি পাস শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা অনেকটাই আন্তর্জাতিক মানের নিচে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা গড়ে আন্তর্জাতিকভাবে সপ্তম শ্রেণির সমতুল্য জ্ঞান ও সক্ষমতা অর্জন করছেন। বিষয়টি শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তুলেছে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই উদ্বেগ আরও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি শিশু ১৮ বছর বয়সে সাধারণত ১১ বছর মেয়াদি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করে (১ম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি)। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা শেখার মান বিবেচনায় এর মধ্যে কেবল ৬.৫ বছরের সমতুল্য শিক্ষাই অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। অর্থাৎ, শিক্ষাবর্ষ (Learning-Adjusted Years of Schooling) অনুযায়ী বাংলাদেশ অন্তত ৪.৫ বছর পিছিয়ে আছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি শিশুর ১৮ বছর বয়সে সাধারণত ১১ বছরের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা (১ম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) সম্পন্ন করার কথা। তবে শেখার গুণমান ও দক্ষতা বিবেচনায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা মাত্র ৬.৫ বছর সমতুল্য মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রায় সাড়ে চার বছরের মানঘাটতি বিদ্যমান, যা শিক্ষার গুণগত দুর্বলতার একটি বড় প্রমাণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন শিশু যদি ৪ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হয়, তাহলে ১৮ বছর বয়সে তার আনুষ্ঠানিকভাবে ১০.২ বছর শিক্ষা সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু শিক্ষার গুণমান বিবেচনায় সে প্রকৃত অর্থে শুধু ৬ বছর সমমানের শেখা অর্জন করছেন। অর্থাৎ, শেখার গুণমানের বিচারে ৪.২ বছরের ঘাটতি রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীদের যে ঘাটতির কথা বলা হয়েছে সে বিষয়ে অবগত শিক্ষা প্রশাসন। তারা বলছে, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিকূলতা রয়েছে। এসব প্রতিকূলতার কারণে সামাগ্রিক শিক্ষার উন্নয়ন হচ্ছে না। তবে শিক্ষার মানোন্নয়নে তারা কাজ করছেন। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বেতন বৃদ্ধিসহ নানা জায়গায় কাজ করছেন। হঠাৎ করেই শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য সময় প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সমন্বিত আন্তর্জাতিক টেস্ট স্কেলে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা গড়পড়তা ৩৬৮ স্কোর করেছে, যেখানে ৬২৫ স্কোর মানে ‘উন্নত অর্জন’ এবং ৩০০ স্কোর মানে ‘ন্যূনতম অর্জন’। এই স্কোর নির্দেশ করে, দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাঠ, লেখালেখি ও গণিতের মতো মৌলিক দক্ষতায় দুর্বল, যা শিক্ষার প্রকৃত মান হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ।
বাংলাদেশের এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা ৫ বছর প্রাথমিক, ৫ বছর মাধ্যমিক এবং ২ বছর উচ্চমাধ্যমিক মিলিয়ে মোট ১২ বছরের শিক্ষা সম্পন্ন করে। অথচ শেখার মানদণ্ডে আন্তর্জাতিকভাবে তারা মাত্র সপ্তম শ্রেণির সমমানের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করছে। এই ব্যবধান শুধু সংখ্যার ঘাটতি নয়, বরং শিক্ষার প্রকৃত গুণগত দুর্বলতা এবং জ্ঞান অর্জনের অসারতা প্রকাশ করে। এর ফলে শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো দেশই আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘাটতি শুধু আনুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম শেষ করায় নয়, বরং শিক্ষার্থীর বাস্তব জ্ঞান, বিশ্লেষণ ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সমন্বিত চিন্তার অভাবেই তৈরি হয়েছে। বর্তমানে এইচএসসি পাশ করা অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন না। ভর্তির পর রচনামূলক প্রশ্ন বুঝতে পারেন না। প্রোগ্রামিং, গণিত বা গবেষণাভিত্তিক বিষয়গুলোতে ভয়াবহ ঘাটতি দেখা যায়। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতাকে দায়ী করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মুখস্থনির্ভর পাঠদান, পরীক্ষাভিত্তিক মেধা যাচাই, পাঠ্যবইয়ের বাইরে বিশ্লেষণধর্মী শেখার অভাব এবং প্রশিক্ষণহীন বা নিম্নদক্ষ শিক্ষকদের কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন কমন পড়া বা গাইড বইয়ের মুখস্থ জবাব দিয়েই উত্তীর্ণ হচ্ছে। কিন্তু তারা আন্তর্জাতিক মানে চাহিদাসম্পন্ন দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ। এর অন্যতম কারণ-শিক্ষকদের যথাযথ জ্ঞানের অভাব এবং শ্রেণিকক্ষে সঠিক পাঠদান না দেওয়া।
তারা বলছেন, এই সংকট থেকে উত্তরণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। সংকটে নিরসনে পাঠ্যক্রমে বিশ্লেষণধর্মী শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। শিক্ষকের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে। একইসঙ্গে পরীক্ষার ধরনে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার গুণমান মূল্যায়নের ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
শিক্ষায় অনেক বেশি ইনভেস্টমেন্ট দরকার জানিয়ে ঢাবির আইইআর-এর একজন অধ্যাপক বলেন, ‘বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হলে শিক্ষার মান উন্নত হত। তবে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের আপনি ১২ হাজার টাকায় শিক্ষকতা পেশায় নিতে পারবেন না। তাকে সেই ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এজন্য শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ দরকার। তবে আমরা বিনিয়োগ করি ভিন্নখাতে। ঘন ঘন কারিকুলাম পরিবর্তনের ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু না শিখে কেবল মুখস্ত করে। আইসিটি, গণিতের মতো বিষয় মুখস্ত করে পরীক্ষা দেয়। এগুলোর কারণে আমাদের দেশের শিক্ষার মান নিম্নমুখী।’
শিক্ষার মানের ঘাটতি অর্থনীতিতে ফেলছে নেতিবাচক প্রভাব
বাংলাদেশে গত দুই দশকে শিক্ষায় পরিমাণগত অগ্রগতি লক্ষ্যণীয় হলেও গুণগত ঘাটতি এখন জাতীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ বলছে, শিক্ষার্থীদের দুর্বল মৌলিক দক্ষতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতার অভাব এবং সমস্যা সমাধানের অক্ষমতা দেশের শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মীর ঘাটতি তৈরি করছে। এর ফলে দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি শুধু শিক্ষাব্যবস্থার নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাগত দুর্বলতা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হ্রাস করছে এবং দারিদ্র্য বিমোচনের পথেও বড় বাধা তৈরি করছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ইস্ট এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো যেমন দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সফল হয়েছে, বাংলাদেশকেও সে পথে এগোতে হলে শিক্ষার গুণগত মানে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশ গত দুই দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য হ্রাসে প্রশংসনীয় সাফল্য দেখিয়েছে, সেই দেশেই শিক্ষার গুণগত দুর্বলতা ভবিষ্যতে অগ্রগতিকে শ্লথ করতে পারে।
মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক
মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানও আশাব্যঞ্জক নয়। বিশ্বব্যাংকের হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্স (HCI) অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ১৫৭টি দেশের মধ্যে ছিল ১০৬তম অবস্থানে। সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ০.৪৮ অর্থাৎ, যদি বর্তমান শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে আজকের একটি শিশু ভবিষ্যতে তার সম্ভাব্য উৎপাদনশীলতার মাত্র ৪৮ শতাংশ অর্জন করতে পারবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামগ্রিক সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে শিক্ষাকে শুধু সংখ্যা বা সনদের ভিত্তিতে নয় দক্ষতা, ব্যবহারিক জ্ঞান এবং বিশ্লেষণক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গুণগতভাবে উন্নত করতে হবে। শিক্ষার মানঘাটতি শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল করাকে কেন্দ্র করে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার ফল। পাঠ্যবই মুখস্থ করে পরীক্ষায় নম্বর পেলেও বাস্তব জীবনে প্রাসঙ্গিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছেন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শুধু পরীক্ষা-নির্ভর শিক্ষা নয়, বরং বিশ্লেষণী চিন্তাশক্তি, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী পাঠদান পদ্ধতি চালু করার আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।
You cannot copy content of this page