এম. আরিফুজ্জামান, পিরোজপুর প্রতিনিধি: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আজকের দিনে পিরোজপুরের রাজপথ ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতা ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দখলে। আগের দিন (৪ আগস্ট) ছাত্রজনতার প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। এতে করে ছাত্রজনতার মানসিক শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, পাশাপাশি ৪ আগস্ট যখন তারা জানতে পারে লংমার্স টু ঢাকা ৬ আগস্টের পরিবর্তে একদিন এগিয়ে ৫ আগস্টে নিয়ে আসা হয়েছে এটা শুনে ছাত্রজনতা আরও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
তবে দুপুরে সেনাপ্রধান ভাষণ দিবেন, এটা জানার পর এদিন দুপুর পর্যন্ত ছাত্রজনতা কোন মিছিল সমাবেশ না করলেও শহরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ছিল তাদের অবস্থান।
এরমধ্যে দুপুর দুইটার দিকে যখন শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে, তখন বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে ওঠে ছাত্র জনতা। মুহূর্তেই ছাত্রজনতাসহ সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পিরোজপুর শহর পরিণত হয় এক মিছিল ও আনন্দ-উল্লাসের নগরীতে। তখন মিছিলে স্লোগান ওঠে, “এইমাত্র খবর এলো শেখ হাসিনা পালিয়ে গেল” এবং “পালাইছেরে পালাইছেরে (পালিয়েছে) খুনি হাসিনা পালাইছে”। এছাড়া ঈদের আনন্দের মত সাধারণ মানুষ পরস্পরের সহিত কোলাকুলি করতে থাকে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের কান্না শুরু করে এবং শুরু হয় মিষ্টি বিতরণ। বিকেলের মধ্যে পিরোজপুর শহরের সকল মিষ্টির দোকান খালি হয়ে যায়।
বিকাল ৪টার দিকে শহরের কেন্দ্রস্থল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ মোড়ে ‘স্বাধীনতা স্টেজ’ তৈরি করা হয়। সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত চলে বিজয় আনন্দ।
এ স্টেজে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন দলের নেতারা বক্তব্য দিতে থাকেন এবং জাসাসসহ স্থানীয় শিল্পীরা দেশাত্মবোধকসহ বিভিন্ন গান পরিবেশন করেন।
বিকেল ৫ টা থেকে শুরু হয় স্বৈরাচার-ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িতে জনতার হামলা। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল, সংসদ সদস্য শম রেজাউল করিম, পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেকসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাদের বাড়িতে উত্তেজিত জনতা আগুন ধরিয়ে দেয়।
পিরোজপুরের আন্দোলনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই মূলত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আর বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলের নেতারা সব সময় ব্যাকআপ টিম হিসেবে কাজ করেছে।
এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজ, আফতাব উদ্দিন কলেজ, সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
এই আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সহযোগিতাও ছিল উল্লেখ করার মতো।
জেলা জামায়াত এবং শিবিরের নেতাকর্মীরা হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবরে দুপুর দুইটার দিকে প্রথমেই নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থিত আল্লামা সাঈদী ফাউন্ডেশনে প্রয়াত মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর কবর জিয়ারত করে মিছিল নিয়ে শহরের দিকে রওনা হন।
বিএনপি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা এবং সাধারণ জনগণ সবাই শেখ হাসিনার পলায়নের খবরে রাস্তায় নেমে আসে এবং উৎসবে মেতে উঠে।
এ প্রসঙ্গে জেলা বিএনপি যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ রিয়াজউদ্দিন রানা বলেন, দুপুর ১২ টায় নতুন বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রায় হাজারখানেক লোকের মিছিল নিয়ে পুরাতন বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগোতে থাকি কিন্তু পথিমধ্যে পুরাতন পেট্রোল পাম্পের সামনে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পের সদস্যরা আমাদেরকে বাধা দেন। আমি আমার পরিচয় দিয়ে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হই যে আমাদের মিছিল হবে শান্তিপ্রিয়। তখন তারা আমাদের মিছিলকে সামনে যেতে দেয়।
শহরের বড় মসজিদ মোড়ে অস্থায়ী ‘স্বাধীনতা স্টেজ’ তৈরি করা হলে সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত আন্দোলনে শরিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা বক্তব্য দিতে থাকেন।
এভাবেই অবসান হয়েছিল দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরাচারের নিপীড়ন। পিরোজপুরের মানুষ পেয়েছিল মুক্তির আনন্দ এবং নতুন স্বাধীনতার স্বাদ।
You cannot copy content of this page