শিক্ষা মূলত একটি বহুমাত্রিক পদ্ধতি, যেখানে শিক্ষকের কাজ থাকে শিক্ষার্থীর অনুসন্ধিৎসু হৃদয়কে জ্ঞানের আলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
বিশ্বের সব থেকে সেরা শিক্ষা ব্যবস্থা পদ্ধতি যে দেশে প্রচলিত, সেই দেশটির নাম – ফিনল্যান্ড।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষকেরা অত্যন্ত স্বাধীনভাবে ও কর্তৃত্বের সঙ্গে তাঁদের নিজ দায়িত্বের সীমা অতিক্রম না করে তা পালন করে থাকেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রও নিশ্চিত করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা।
ফিনিশ শিক্ষাব্যবস্থায় মনে করা হয় শিশুদের শিশুর মতই থাকতে দেওয়া উচিৎ। অযথা হোমওয়ার্ক কিংবা এসাইনমেন্টের বোঝা চাপিয়ে শিক্ষার্থীর জীবন দুর্বিষহ করার ব্যাপারে তাঁরা পক্ষপাতী নন। তাই ফিনল্যান্ডের হাইস্কুলগুলোতে এত অল্প হোমওয়ার্ক দেওয়া হয়, যে গুলো রাতে মাত্র আধা ঘন্টাতেই শেষ হয়ে যায় এবং এলিমেন্টারি ও জুনিয়র স্কুলগুলোতে কোন হোমওয়ার্কই দেওয়া হয়না।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার ‘হৃৎপিণ্ড’ হয়ে আছেন সে দেশীয় শিক্ষকরা। সেখানে শিক্ষকদের উপর আস্থা এবং স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাস করা হয়। সহায়িকা হিসেবে আছে মৌলিক কিছু গাইডলাইন যেগুলোর বিস্তৃতি আসলে বহুদূর। সেগুলোর ভিতর থেকে চেষ্টা করা হয় শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা ও মান উন্নয়নে। শিক্ষার্থী যাতে সহজে এবং ভালোভাবে শিখতে পারে সেদিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়। সেখানকার শিক্ষকরা কঠোর পরিশ্রমী সেই সাথে এই পেশা সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ। শিক্ষক হওয়ার জন্য অবশ্যই মাস্টার্স ডিগ্রীর অধিকারী হতে হয়। প্রচণ্ড প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে তবেই হতে হয় শিক্ষক।
শিক্ষকরা এমনভাবে প্রশিক্ষিত হন যাতে করে সব রকমের শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষা সমানভাবে পৌঁছে দিতে পারেন। এমনকি শিক্ষার্থীর শারীরিক কিংবা ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা সহ শিক্ষাজনিত অন্য সকল ইস্যুতে শিক্ষকরা যাতে উৎরে আসতে পারেন সে লক্ষ্যে সব ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শিক্ষকদের। ক্লাসে নিয়মিত শিক্ষাদানের পাশাপাশি শিক্ষকদের নিজেদের জ্ঞানার্জন থেমে থাকেনা। পেশাদারিত্ব উন্নয়নের জন্য ফিনিশ শিক্ষকদের প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হয়। এবং এই ব্যয় ফিনল্যান্ডের সরকারই বহন করেন।
কঠোর পরিশ্রম এবং শিক্ষাদানের এর বিনিময়ে শিক্ষকরা কি পান?ফিনল্যান্ডে সবচাইতে মর্যাদাপূর্ণ এবং উচ্চ বেতনভোগী পেশাজীবী হচ্ছেন শিক্ষকরা। আইন কিংবা চিকিৎসা পেশার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় ভাবা হয় শিক্ষকতাকে। যার ফলে ফিনল্যান্ডের তরুণদের কাছে শিক্ষকতা এখন সবচাইতে আকাঙ্ক্ষিত পেশা। পুরো বেতন কাঠামো কিংবা সুযোগ সুবিধার কথা না বলতে পারলেও খুব অল্পের মধ্যে বলে যাই, একজন ফিনিশ তরুণ শিক্ষকের প্রারম্ভিক বেতন $২৯০০০।
ফিনল্যান্ডে তেমন কোন বড় পাবলিক পরীক্ষা নেই। কেবল উচ্চ মাধ্যমিক পড়ালেখা শেষে ন্যাশনাল ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষা নামে একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। এখানে যে সবাই অংশগ্রহণ করে তেমন নয়। গোটা শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা পর্যালোচনা করার জন্য কিছু শিক্ষার্থীকে নির্বাচন করা হয় এবং তাদের পরীক্ষাই কেবল নেওয়া হয়। তাহলে ফিনিশ শিক্ষার্থীদের মান কিভাবে নির্ধারিত হয়? তাদের পরীক্ষাগুলো হয় প্রজেক্ট নির্ভর। ক্লাসগুলোকে অযথা চাপমুক্ত রাখা হয়। আনন্দদায়ক এবং সৃজনশীল ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জীবনের পাথেয় শিক্ষা নেওয়াটাকেই দরকারি মনে করেন ফিনিশ নীতিনির্ধারকরা। জীবনের প্রথম বছরগুলোতে ‘তথাকথিত’ সাফল্যের চাইতে একজন শিক্ষার্থী কি শিখলেন, সেটাকেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন তাঁরা। কিভাবে শিখতে হবে, কিভাবে জীবনযাপন করতে হবে অথবা কিভাবেই বা খুঁজে পাওয়া যাবে নিজের আগ্রহের জায়গা-এগুলো শিখানো হয় একেবারে এলিমেন্টারি পর্যায়ে।
ফিনল্যান্ডে সেরা স্কুল কিংবা শিক্ষকের কোন তালিকা নেই। কারণ ফিনিশরা মনে করে প্রকৃত বিজয়ীকে কখনোই প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়না। ফলে ফিনিশ স্কুলগুলোতে প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতার মনোভাব বিরাজ করে। যেহেতু সর্বসেরা হওয়ার কোন ইদুর দৌড় সেখানে নেই, সবাই একত্রে কাজ করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে এবং সেই সব সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে কল্যাণ বাড়াতে।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা সেরা স্কুল তৈরির বদলে লেভেল প্লেয়িং তৈরিতেই বেশি আগ্রহী যেখানে সব স্কুলে শিক্ষার জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে। এক্ষেত্রে পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড,আয় কিংবা ভৌগলিক অবস্থান যাতে প্রতিবন্ধকতা না হয়ে উঠতে পারে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়। প্রত্যেক স্কুলের জন্য সমান বরাদ্দ দেওয়া হয় সেটা যে কমিউনিটির কিংবা দেশের যে স্থানের স্কুলই হোক না কেন। দুর্গম অঞ্চলগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধা বরাদ্দ রাখা হয়।
ফিনিশ স্কুলগুলো সম্পূর্ণ ভাবে ফ্রি। এর মধ্যে খাবার-বই-ভ্রমণ সহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সব কিছু অন্তর্ভুক্ত।বিরাট সব দালান নির্মাণের বদলে ফিনিশ শিক্ষাব্যবস্থায় ক্লাসের ভিতরের পরিবেশের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়। এলিমেন্টারি লেভেলের কোন ক্লাসেই ২৪ জন এর বেশি শিক্ষার্থী অনুমোদন করা হয় না। অল্প শিক্ষার্থী, যথেষ্ট দক্ষ শিক্ষক এবং আনন্দদায়ক একটা পরিবেশের মধ্য দিয়েই তরতর করে এগিয়ে চলেছে ফিনল্যান্ডের শিক্ষাতরী।
এই যে বিশাল দক্ষযজ্ঞ এর পিছনে অর্থ যোগায় কে? লেখা এতটুকু পড়েই আশা করি বুঝতে পারছেন যে, ফিনল্যান্ডের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাই ফিনিশ শিক্ষাব্যবস্থাকে এত উন্নত ও কল্যাণমুখী করে তুলেছে। জিডিপির ৬% সরাসরি শিক্ষাখাতে ব্যয় করা হয়।প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারী। অল্প কিছু ব্যক্তি উদ্যোগে চালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সেগুলোও সরকারী অনুদানের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু শিক্ষা খাতে এত বরাদ্দের উদ্দেশ্য কি?গত শতাব্দীর ৭০ এর দশকেই ফিনল্যান্ডের নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পেরেছিলেন, ফিনল্যান্ডের স্বল্প প্রাকৃতিক সম্পদ ও ক্ষুদ্র আকারের ভারী শিল্প উন্নয়ন আসলে সেইভাবে সম্ভব নয়। সামর্থ্যের এই সীমাবদ্ধতাই তাদেরকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি নির্মাণে আগ্রহী হয়ে করে তোলে। যার ফলে এখন ফিনিশরা আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা করার জন্য অন্যদের চাইতে এগিয়ে আছে।
পরিশেষে বলতে চাই আমাদের দেশের শিক্ষার বর্তমান অবস্থা দেখে কেউ হয়তো সাহস করে বলতে পারবে না এ জাতির ভবিষ্যৎ ভালোর দিকে যাচ্ছে, বরং মন ভারী করে ভাবতে হবে কতটা খারাপ দিকে যাচ্ছি আমরা। তাই এখনই সিধান্ত নিতে হবে সুন্দর সুশিক্ষিত দেশ ও জাতি গঠনে।
আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা দিকে দেখলে দেখা যায় জোর করে ছোট থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যে সময় খেলার ছলে শেখার কথা সেই সময় কেন স্কুল এ ১০ ঘণ্টা থাকতে হবে?
কেন নিজের ওজনের থেকে বেশি বই কাঁধে নিতে হবে?
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও মূল্যবোধের এখনই পরিবর্তন দরকার। নয়তো হারিয়ে যাবে এ জাতির স্বপ্নের সোনার বাংলার সোনার মানুষেরা…।।
এম. আরিফুজ্জামান, সিনিয়র শিক্ষক (গণিত), ইন্দুরকানী মেহেউদ্দিন মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পিরোজপুর।
You cannot copy content of this page